জিরো বাউন্ডারি কবিতার তৃতীয় বর্ষ/ দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য লেখা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখ। দুটো কবিতা বা কবিতা বিষয়ক মৌলিক লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ইমেলে-0boundarykabita17@gmail.com

ব্লগে অনুসন্ধান করুন

জফির সেতু




কবি শফিকুল ইসলামের অনুভূতি ও সৃষ্টির জগৎ
==============================


শফিকুল ইসলাম একজন নিভৃতচারী কবি। । এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে কবির ৭টি কবিতার বই। এসবের ফ্ল্যাপ পড়ে জানা যায়, তিনি আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই লেখালেখি করে আসছেন এবং এ পর্যন্ত কয়েকটি পুরস্কার ও পদকও লাভ করেছেন।

সম্প্রতি সাহিত্যপ্রেমী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার অগ্রজ ইশফাকুল হোসাইনের সৌজন্যে কবি শফিকুল ইসলামের তিনটি কবিতার বই আমার হাতে এসেছে। বইগুলো হচ্ছে তবুও বৃষ্টি আসুক (২০০৭), মেঘভাঙা রোদ্দুর (২০০৮) ও দহনকালের কাব্য (২০১১) । এ ছাড়াও তার শ্রাবণ দিনের কাব্য, প্রত্যয়ী যাত্রা, একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি এবং এই ঘর এই লোকালয় নামের আরো কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে ।

কাব্যগুলো পাঠে কবির মনোজগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়, তাঁর অনুভূতির জগৎ, উপলব্ধির জগৎ সম্পর্কে স্পষ্টতাও মেলে। সর্বোপরি পরিচয় মেলে কবির জীবনদর্শনেরও । সেদিক থেকে শফিকুল ইসলাম একধারে রোমান্টিক ও সাম্যবাদী ধারার কবি এবং কাজি নজরুল ইসলামের উত্তর সাধকও।

তবুও বৃষ্টি আসুক কাব্যটি আগোগোড়াই রোমান্টিক ধাঁচের। বিবৃতিধর্মী কবিতাগুলো সত্তর দশকের বাংলা কবিতার উত্তরসূরী হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। তবে সত্তরের প্রধান কবিদের মধ্যে যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিযোজনা লক্ষ্য করা যায়, শফিকুল ইসলাম একেবারেই অনুপস্থিত । তিনি বরাবরই সাদামাটা কবিতা লেখতে অভ্যস্ত। তাই বলে কবিতা স্বাভাবিক প্রবণতা কখনওই উপেক্ষা করেননি। ফলে যে বিষয়গুলো একটা বক্তব্য বা ভাষাকে কবিতা করে তোলে, যেমন, ভাব, ছন্দ ও অলংকার তার প্রতি এই কবির স্বভাবত অনুরাগ চোখে পড়ার মতো।

তবুও বৃষ্টি আসুক বইয়ে দেখা যাবে একজন স্মৃতিভারাতুর কবি হিসেবে তাকে; একটা নস্টালজিক চেতনা তাকে সর্বদা পীড়িত করছে। প্রকৃতির কোলেও তিনি এক নিঃসঙ্গ সত্তা; সকলের সঙ্গে থেকেও তিনি একা। এই অনুভব চির রোমান্টিক মানসের। তা-ই আমরা দেখি পৃথিবীর তিনভাগ জল, একভাগ স্থল’ কবিতায়, 

পৃথিবীর তিনভাগ জন একভাগ স্থল
অথচ আমার জীবনে একভাগ ও স্থল নেই,
পুরো চারভাগই জল-
আজীবন দুঃখ আর নিঃসঙ্গতাই
আমাকে সঙ্গ দিয়েছে,
অশ্রুজল উপজীব্য করে আমি আজও বেঁচে আছি।

এ রকম কথা একজন রোমান্টিক কবিই বলতে পারেন। ফলে তাঁর কাব্যে সর্বদাই একটি অনুভূতিশীল সত্তার অনুভব আমরা লক্ষ্য করি। এই অনুভূতিশীলতা কখনও ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমষ্টিক চেতনাকেও স্পর্শ করে।

হয়ত এইজন্যে তবুও বৃষ্টি আসুক রোমান্টিক ধাঁচের কাব্য হলেও শেষ পর্যন্ত এটি সমষ্টিক চেতনাকে ধারণ করেছে। পরবর্তীকালে প্রকাশিত দহনকালের কাব্যে যে মাটি মানুষের প্রতি কবির দায়বদ্ধতা দেখা যাবে; এ কাব্যে তার প্রথম স্ফূরণ আমরা লক্ষ্য করব। কেননা, কবি প্রথম কবিতায়ই নিজের তলিয়ে যাওয়ার শংকার চেয়ে ইথিওপিয়া, সুদান প্রভৃতি দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশের মানুষের কষ্টে নতজানু হতে দেখি।

মেঘভাঙা রোদ্দুর প্রন্থটি একটি গীতিকবিতার সংকলন। গ্রন্থিত কবিতাগুলোকে কবিতা না বলে গীত বলাই হয়ত যুক্তিযুক্ত। বোঝা-ই যায় সুর সংযোজন ও গীত হওয়ার জন্য এগুলো রচিত। তা যাই হোক। স্বাভাবিক কবি প্রবণতা এখানেও উপস্থিত, প্রত্যেকটি কবিতায়ই। ভাবের দিক থেকে সকগুলো কবিতাই ব্যক্তিক অনুভূতির ছন্দোবদ্ধ প্রয়াস। ব্যক্তি মানুষের প্রেমবোধ, নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা ও মগ্নতা কবিতাগুলোর অন্তর জুড়ে ব্যাপৃত। পঞ্চাশ দশক থেকে বাংলাদেশে যে গীতিকবিতার ধারা চলছে গীতগুলোতে তার অবয়ব ও সুর স্পষ্ট।

দহনকালের কাব্য বইটিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ইশতেহার নিয়ে এসেছেন কবি কাব্যজগতে। সেটি হচ্ছে গণমুক্তি ও সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। এ ধরনের কবিতা বাংলা সাহিত্যে গত শতকের তিরিশের দশকে এসে নতুন মাত্রা পায়। নজরুল এ ধারার রূপকার হলেও, চল্লিশের দশকে সুভাষ-সুকান্তরা এ ধারাকে বেশ জনপ্রিয় ও সর্বগণ্য করে তোলেন।

তিরিশের দশকে প্রগতি লেখকসংঘ ও সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে যে সাহিত্যিক জোয়ার আসে; বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি তৈরি হয় তার প্রেক্ষাপটেই এধারা বিকশিত হয়। ষাটের গণআন্দোলন, বাংলাদেশর স্বাধীনতাযুদ্ধ ও আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও পরবর্তীকালে এ ধরনের কবিতা রচনায় কবিদের অনুপ্রাণিত করেছিল । সে ধারাবাহিকতা দহন কালের কাব্য-এ পরিলক্ষিত হয়।

এমন কি আমার মনে হয় শফিকুল ইসলাম গীতিপ্রবণ কবি হওয়ার কারণে, গণসংগীতের মেজাজও কাব্যটিতে প্রতিফলিত হয় । এ কবির কবিতার সঙ্গে গণমানুষের কবির কবিতার একটা মিল পরিলক্ষিত হয়, অন্তত বিষয় ও প্রকরণের দিক থেকে। এ কাব্যের মূল চেতনা মানুষের আত্মিক ও সামাজিক জাগরণ। জয় হবে জয় হবে’ কবিতায় কবি বলেছেন,

জয় হবে জয় হবে
এবার মেহনতি জনতার জয় হবে,
শ্রমিকের কৃষকের তাতী আর মজুরের
হাত এবার হাতিয়ার হবে।
ললাটের ঘাম আর দেহের শ্রম দিয়ে
পরের ভাগ্য এতদিন দিয়েছি বদলায়ে,
এবার বুকের রক্তে আপন ভাগ্য বদলাতে হবে।

আর এখানেই কবি হয়ে ওঠেন সর্বমানুষের। এ কাব্যের পরতে পরতে বৈপ্লবিক কন্ঠ পরিলক্ষিত হলেও সারাটা কাব্য জুড়ে কবি নিজের একটা কন্ঠ নির্মাণ করতে চেয়েছেন। এই কন্ঠ ভাষার, মেজাজের। শুধু যে স্থানিক বা কালিক মানুষের মুক্তির স্বপ্ন কবিতায় দেখছেন কবি তাও কিন্তু নয়, সে মানুষ স্থান ও কালের উর্ধ্বে। মানুষের প্রতি কবির এ মমত্ব ও দায় এ গ্রন্থের সবচেয়ে বড়ো বিষয়। সার্থকতা বলতে এখানেই ।

সর্বোপরি যেটা দেখা গেল, কবি শফিকুল ইসলাম যাত্রা করেছিলেন ব্যক্তিক অনুভূতি ও উপলব্ধি নিয়ে, কিস্তু সময়ের ব্যবধানে তিনি পৌছেছেন সমষ্টিক চেতনার জায়গায়; কবির এই বিবর্তন মানবিক চেতনারও বিবর্তন। এই বিবর্তনধর্মিতাই কবিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।






No comments:

Post a Comment